রাতের সেন্ট মার্টিনসে সূর্যের পরশ
http://www.kalerkantho.com/print-edition/campus/2019/03/06/744186
শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চের পরিচালক। তাঁর গবেষণার সুফল হিসেবে রাতের বেলা আলো জ্বলছে সেন্ট মার্টিনসে। তাঁর ভ্রমণসঙ্গী হয়ে সেই গল্প জানাচ্ছেন মীর হুযাইফা আল মামদূহ
এক বছর আগেও রাতের সেন্ট মার্টিনস ভারী জেনারেটরের প্রচণ্ড দাপটে কাঁপত। পর্যটকদের বৈদ্যুতিন সেবা দেওয়ার জন্য ছিল এসব জেনারেট। অথচ এগুলো এই প্রবাল দ্বীপের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। এ বছর সেই ঝুঁকি কিছুটা কমেছে। তাই বলে আলোর কমতি হয়নি। বিভিন্ন রিসোর্ট ও কিছু বাসাবাড়িতে এখন জেনারেটর ছাড়াই আলো জ্বলছে। কারণ সেন্ট মার্টিনস ছোঁয়া পেয়েছে এক আশ্চর্য জাদুকরের। সূর্যের আলোর শক্তি ধরে রেখে কিভাবে বড় পর্যায়ে বৈদ্যুতিক চাহিদার জোগান মেটাতে হয়, তা সেন্ট মার্টিনসবাসীকে বাতলে দিয়েছেন তিনি। বলছি শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরীর কথা। তিনি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর এনার্জি রিসার্চের পরিচালক। বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায়, তাঁর নিবিড় তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই গবেষণাকেন্দ্রটি এখন বিভিন্ন সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি মিনি গ্রিডের নকশা এবং সৌরবিদ্যুৎ-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে কাজ করছে।
বুয়েটের পাঠ শেষ করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে যোগ দিয়েছিলেন শাহরিয়ার। এরপর জার্মানি গিয়েছিলেন নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে লেখাপড়া এবং বিশেষ করে সৌরকোষ নিয়ে গবেষণা করতে। গবেষণা শেষে এমন এক সৌরকোষ তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যেটির কার্যকরী দক্ষতা সে সময় পৃথিবীব্যাপী রেকর্ড গড়েছিল। এটি ২০০৬ সালের গল্প। এরপর তিনি দেশে ফিরে আসেন। সেই থেকে এ পর্যন্ত দেশের ২০টি এমন জায়গার জন্য সৌর মিনি গ্রিডের কারিগরি নকশা তিনি করে দিয়েছেন, অবকাঠামোগত কারণে যেখানে অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ পৌঁছুবার ব্যাপারে অপারগতা জানিয়েছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। সেন্ট মার্টিনস তেমনই একটা জায়গা। সাগর পাড়ি দিয়ে সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছানো খুব কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনসে এখন চোখে পড়ে শহরের মতো বৈদ্যুতিক পিলার; সেখানে তৈরি হয়েছে একটি সৌরচালিত মিনি বিদ্যুৎ গ্রিড। এর উদ্যোক্তা ব্লু মেরিন রিসোর্টের কর্ণধার মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী।
৩১ জানুয়ারি রাতে শাহরিয়ার সেন্ট মার্টিনস গিয়েছিলেন এই সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাণিজ্যিক উৎপাদনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী আয়োজনে। তাঁর সঙ্গী হয়ে আমিও দেখে এসেছি এই সৌরবিদ্যুতের যজ্ঞ। ১ ফেব্রুয়ারি রাতে আমরা বেরিয়েছিলাম ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলতে। বাজার থেকে একটু এগোতেই আবু তাহেরের দোকান। তিনি ঘরে আর দোকানে লাইন নিয়েছেন। জানালেন, দোকানে আগে জেনারেটরের আলো নিতেন। তাতে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত পাঁচ-ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। এখন সৌরবিদ্যুতের কল্যাণে ২৪ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকে। দোকানি আবুল কালাম এর আগে বহুল পরিচিত স্ট্যান্ড-অ্যালোন সোলার হোম সিস্টেমের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতেন। সেটি কয়েক দিন পরেই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন এই প্রকল্পের বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তিনি আশাবাদী। আমরা দ্বীপের বেশ ভেতরের দিকের একটা বাড়িতে গেলাম। দেখা মিলল নরসিংদীর অধিবাসী জামালুদ্দিনের। শ্বশুর বাড়িতে তিনি বেড়াতে এসেছেন। জানালেন, আগেরবার এসে রাতে ঘরে বিদ্যুতের আলো পাননি; এবার পাচ্ছেন। ‘সদ্যই শুরু হওয়া এই মিনি গ্রিডের বিদ্যুৎ অবশ্য এখনো তেমন পরিচিতি পায়নি। পরিচিত হওয়ার পর সবাই এটাই ব্যবহার করবে।’ বলছিলেন, বৈদ্যুতিক কাজের দায়িত্বে থাকা এসকিউব টেকনোলজির ইঞ্জিনিয়ার ও শাহরিয়ারের প্রাক্তন ছাত্র নাজমুল ইসলাম। সেন্ট মার্টিনসজুড়ে ১৫.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন স্থাপন করা হয়েছে। এই মিনি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা এখন আড়াই লাখ ওয়াট। চাহিদার ওপর ভিত্তি করে এটির উৎপাদন ক্ষমতা ভবিষ্যতে আরো বাড়ানো হতে পারে বলে জানালেন শাহরিয়ার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কম্পানি লিমিটেড (ইডকল) এই প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করেছে। এসব প্রকল্পে সরকার ৫০ শতাংশ অনুদান দেয়। ৩০ শতাংশ প্রকল্প ব্যয় সহজ শর্তে (৬ শতাংশ সুদের হার) ঋণ দেওয়া হয়। বাকি ২০ শতাংশ খরচ বিনিয়োগ করতে হয় উদ্যোক্তাকে।
ইডকলের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ও শাহরিয়ারের প্রাক্তন ছাত্র হাসান মুহাইমিনুল আজিজ জানালেন, ‘আমরা প্রথমে বিদ্যুৎ পৌঁছানো অসম্ভব—এমন জায়গা খুঁজে বের করি। তারপর স্থানীয় কাউকে খুঁজি, যিনি সৌরবিদ্যুতের জন্য বিনিয়োগ করবেন।’ মুহাইমিনুল আরো জানালেন, ‘আমরা প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সব রকম সহায়তা দিই। বাংলাদেশে এখনো এক হাজার ৬৯টি গ্রাম রয়েছে, যেখানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ পৌঁছানো দুরূহ। আমরা ওই সব জায়গায় মিনি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধমে বিদ্যুতায়নের পরিকল্পনা করছি। এখন ২৬টি প্রকল্প ও ২০টি মিনি গ্রিড চালু আছে। প্রতিটি মিনি সৌর বিদুৎকেন্দ্রের মাধমে ৫ থেকে ১০টি গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব।’
মিনি গ্রিডের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এক্সিলন বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক রিলেন সিদ্দিক জানালেন, ‘সেন্ট মার্টিনসে বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন বসানো বেশ ঝামেলার ছিল। ৪৬৫টি বৈদ্যুতিক পোল আমাদের নিতে হয়েছে। এর জন্য জোয়ার-ভাটার দিকে খেয়াল রাখতে হয়েছে। একবার ১২টি পোল জোয়ারের কারণে ডুবে গিয়েছিল। এক দিন এক রাত অপেক্ষা করে সেগুলো তুলতে পেরেছি। এ ছাড়া এখানে কাজ করা গেছে শুধু শুকনো মৌসুমে। এই সময়ে আবার পর্যটকরাও বেশি আসেন। তাই সকাল ১১টায় জাহাজ পৌঁছার আগ পর্যন্তই শুধু কাজ করতে পেরেছি। কেননা বাকি সময়ে কাজ করলে রাস্তায় জ্যাম হয়ে যেত।’ শাহরিয়ার জানালেন, ‘পৃথিবীব্যাপী সৌরবিদ্যুতের যে বিপ্লব চলছে, তাতে বিশেষত সৌরবিদ্যুিভত্তিক অফ গ্রিড বিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়ে আছে।’
পরদিন সকালে আমরা হেঁটে ছেঁড়াদ্বীপ দেখতে বেরিয়েছিলাম। বাংলাদেশের সবচেয়ে দক্ষিণের এই জায়গায় যেতে যেতে শাহরিয়ার বলছিলেন, ‘ওই দিকটায় সচরাচর কেউ যায় না। অথচ প্রতিবার আমি ওখানে যাই—শেষ বিন্দুটি দেখার ইচ্ছা থেকে। শেষ অবধি দেখার এই তাড়নাই হয়তো আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।’ তিনি আরো জানালেন, মানুষের বসবাসযোগ্য ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য কার্বন নিঃসরণমুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন জরুরি। তাই নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎই আমাদের ভরসা। সূর্যের আলোই এর প্রধান উৎস। তাই সৌরশক্তি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে নিরন্তন কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। শিক্ষকতার পেশায় রয়েছেন বলে একটা বাড়তি সুবিধা রয়েছে তাঁর। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিজের আইডিয়া ঝালিয়ে নিতে পারেন এবং গবেষণায় তাঁদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা গ্রহণ করেন তিনি।
আমরাও চাই, সেন্ট মার্টিনস দিন-রাত সূর্যের আলোতেই আলোকিত থাকুক শাহরিয়ারের হাত ধরে।